ভোরের হালকা কুয়াশা তখনো কাটেনি। বাতাসে শীতের আমেজ। কালাই বাসস্ট্যান্ড থেকে পিচঢালা পথে জয়পুরহাট-বগুড়া আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে আধা কিলোমিটার পূর্ব...
ভোরের হালকা কুয়াশা তখনো কাটেনি। বাতাসে শীতের আমেজ। কালাই বাসস্ট্যান্ড থেকে পিচঢালা পথে জয়পুরহাট-বগুড়া আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে আধা কিলোমিটার পূর্ব পাশে এগোতেই মানুষের হইচই শোনা গেল। এটা পাঁচশিরা মাছের আড়ত। কিন্তু আজ শনিবার এখানে বসেছে এক দিনের মাছের মেলা। উপলক্ষ নবান্ন উৎসব।
মাছের মেলায় প্রায় ৫০টি দোকানে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানা প্রজাতির মাছ। সিলভার কার্প, ব্রিগেড, রুই, কাতল, গ্রাসকার্প, পাঙাশসহ আরও হরেক প্রজাতির মাছ। কোনো কোনো ব্যবসায়ী রংবেরঙের কাগজ দিয়ে সাজিয়েছেন মাছ বিক্রির জায়গা। বড়সড় মাছগুলো সামনে রেখে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে চলছে হাঁকডাক। ক্রেতারা পছন্দের মাছ কিনতে করছেন দর-কষাকষি। বাজেটের মধ্যে এলেই কিনছেন পছন্দের মাছ।
মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রাম-মহল্লায় রীতিমতো উৎসবের আমেজ। নাইওর এসেছেন মেয়ে ও জামাই। নিমন্ত্রণ করা হয়েছে আত্মীয়স্বজনকেও। এই দিনের জন্য পুরো বছর অপেক্ষায় থাকে কালাই উপজেলাবাসী।
পাঁচশিরা বাজারের ব্যবসায়ী গৌতম চন্দ্র চাকী বলেন, পঞ্জিকা অনুসারে আজ শনিবার অগ্রহায়ণের প্রথম দিন হওয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই দিন নবান্ন উৎসব পালন করেন। তবে এই এলাকায় দিনটিতে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই নবান্ন উৎসব পালনের পাশাপাশি মেলাটি উপভোগ করেন এবং এতে অংশ নেন।
মেলার নিকটবর্তী থুপসারা মহল্লা থেকে সপরিবারে মাছ কিনতে এসেছেন শাহনাজ পারভীন শিউলি। তিনি বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই মাছের মেলার কথা শুনে আসছি। কিন্তু আগে কখনো আসা হয়নি। বড় বড় মাছ দেখতে এবং পছন্দের মাছ কিনতে মেলায় এসেছি আজ। মেলাটি বেশ ভালো লাগছে। ঘুরেফিরে মেলা থেকে স্বাদ ও সাধ্যের মধ্যে ৫০০ টাকা কেজিতে ছয় কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ কিনেছি।’
মেলায় মাছ কিনতে আসা খোসালপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেন মণ্ডল বলেন, ‘মেলায় এসে দরদাম করে ৭৫০ টাকা কেজিতে সাড়ে আট কেজি ওজনের একটি কাতল মাছ কিনেছি। অন্য বছরের চেয়ে এবার বড় আকারের মাছের আমদানি এবং দাম দুই-ই কম। গত বছর উঠেছিল ১৮-২০ কেজি ওজনের কাতল ও ব্রিগেড। যেগুলো বিক্রি হয়েছিল ৮০০-৯০০ টাকা কেজিতে। কিন্তু এবার ১২ কেজির চেয়ে বড় মাছ চোখে পড়েনি। সেগুলো বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৮০০ টাকা কেজিতে।’
কালাই পৌরসভার লাইসেন্স পরিদর্শক মোস্তা হাসান বলেন, কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা মাছের আড়ত ও মাছের বাজারে প্রায় দুই যুগ ধরে নিয়মিতভাবে এক দিনের মাছের মেলা বসছে। উপলক্ষ নবান্ন উৎসব। এখন এটা এই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তাই এদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত আশপাশের লোকজন মাছ কিনতে মেলায় ছুটে আসে।
এই মেলার মাছ বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মেলায় ছোট-বড় অন্তত ৫০টি মাছের দোকান বসেছে। এক দিনের এই মেলার জন্য আমরা চাষির কাছ থেকে তাঁদের পুকুর ও দিঘিতে চাষ করা নানা জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেছি। সেগুলোই বিক্রি করছি। ৫-১১ কেজি ওজনের ব্রিগেড ও সিলভার কার্প মাছ বিক্রি করছি ৫০০-৬৫০ টাকা কেজিতে। ৬-৯ কেজি ওজনের রুই ও কাতলা মাছ বিক্রি করছি ৫৫০-৮০০ টাকা কেজিতে। এ ছাড়া ১-৪ কেজি ওজনের রুই, কাতল, ব্রিগেড ও সিলভার কার্প মাছ বিক্রি করছি ২৬০-৩৮০ টাকা কেজিতে।’
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জান্নাত আরা তিথি বলেন, ‘উপজেলার পাঁচশিরায় বসা এক দিনের এই মাছের মেলা ঘিরে এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই মেলার জন্য স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে সপ্তাহখানেক ধরে যোগাযোগ করে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেগুলোই আজ মাছের মেলায় বিক্রি করছেন। এ মেলায় কেউ যাতে বিষযুক্ত মাছ বিক্রি করতে না পারেন, সেদিকে তদারকির জন্য উপজেলা মৎস্য বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া আছে।’
কালাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান মিলন বলেন, ‘নবান্ন উপলক্ষে দুই যুগের বেশি সময় ধরে উপজেলার পাঁচশিরা এলাকায় বসা এক দিনের এই মাছের মেলা এই উপজেলার ঐতিহ্যের ধারক। মেলায় বেচাকেনা কমবেশি যা-ই হোক না কেন, এ মেলা আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে বহন করছে। এটা আমাদের একটি বড় অর্জন।’
মো: চঞ্চল বাবু/ডেইলি জয়পুরহাট
কোন মন্তব্য নেই