দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নারীর পদচারণা। পুরুষদের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করেও কম বেতন ...
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নারীর পদচারণা। পুরুষদের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করেও কম বেতন ও মজুরি বৈষম্যের কারণে এখানকার নারীরা সাফল্যের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। অথচ প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারিভাবে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। দিবসটি উপলক্ষে সারাদেশে নারী-নির্যাতন বন্ধ, নারীর অধিকার ও ন্যায্য মজুরিসহ নানা বিষয়ে সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু এতো কিছু আয়োজন করা হলেও শহরের তুলনায় মফস্বলের বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। গ্রামীন নারীরা যেমন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত, তেমনি পাচ্ছে না ন্যায্য মজুরি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নারী শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য মজুরি থেকে। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সনদে নারী-পুরুষ সম-অধিকারের কথা বলে হলেও বাস্তবে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার চিত্র ভিন্ন। এই উপজেলার নারী শ্রমিকেরা ন্যায্য দিন মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারী শ্রমিকেরা সহজ-সরল অপেক্ষাকৃত কম দামের দিন মজুরি হওয়ায় তাদের চাহিদাও অনেক বেশি। তাদের সংসারে অভাব অনটনের জন্য নিজের ও পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মুল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতিদিন তাদের সংসারের চাহিদা বাড়ছে। যার কারণে তাদের সংসারের চাহিদা মেটাতে পুরুষের সঙ্গে নারীরাও বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে, আর এই সুযোগে মুনিবরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদেরকে কম মজুরি দিয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্টরা ও স্থানীয় সূত্র জানিয়েছেন, উপজেলার পুরুষ শ্রমিকদের সমান কাজ করেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে নারীদের। আজও সমাজের সব স্তরে নারীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। রয়েছে মজুরি বৈষম্য ও নারী নির্যাতনে পাচ্ছে না তেমন ন্যায় বিচার। এভাবে নারী শ্রমিকরা যুগের পর যুগ নির্যাতন সহ্য করে জীবন-জীবিকার তাগিতে পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে-ঘাটে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছে। অথচ দেশে প্রতিবছরই নারী অধিকার, মজুরিসহ নানা বিষয়ে সমঅধিকার নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার হয়ে থাকে। কিন্তু মজুরি বৈষম্য কমেনি। পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরি পান নারী। উপজেলাতে পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে নারী শ্রমিকেরা প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। নারী শ্রমিকেরা যে কোন কাজে ফাঁকি না দিয়ে অল্প মজুরিতে বেশি কাজ করছেন তারা। উপজেলার নারী শ্রমিকরা ঘরের কাজের বাইরে গিয়ে জমিতে ধান রোপণ, নিড়ানি, এমনকি ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে, ইট-পাথর ভাঙা ও টানা, মাটি কাটা, হোটেল, দোকানে পানি সরবরাহ, নির্মাণ শ্রমিকসহ দিনমজুরের কাজ করছেন। তারা সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে একজন নারী শ্রমিক মজুরি পান ৩০০-৩২০ টাকা। অথচ সেই কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিক প্রতিদিন মজুরি পায় ৬০০-৭০০ টাকা । তারা উভয়ে সমান তালে কাজ করলেও নারী শ্রমিকেরা ন্যায্যমূল্যের দিন মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীরা হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পরেও অন্য পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পাচ্ছেন। তাদের সংসারে অভাব অনটনের কারণে একটু সচ্ছতা ও সুখের জন্য ঐ দিন মজুরির বৈষম্য মেনে নিয়েই অভাব ও ক্ষুধা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারাপ্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই করছেন ঐসব নারী শ্রমিকেরা। উপজেলার সমশিরা মাঠে আলু তোলার কাজ করেন লাভলি বেগম (৩৩)। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্ষেত থেকে আলু তুলার কাজ করে ৩০০ টাকা টাকার বেশি আয় করতে পারেন না। একদিকে মজুরি বৈষম্য অন্যদিকে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। সব মিলিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
কালাই বাসস্ট্যান্ডে আনজুয়ার (৩৭) নামে এক হোটল নারী শ্রমিক বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হোটেলে থাল-বাটি ধোয়ার কাজ করি। পাই ৩২০ টাকা। জীবন বাঁচানোর তাগিদে এবং বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে এই কাজ করছি।
উপজেলার পাঁচশিরা এলাকার চাতাল শ্রমিক লিলি (৪০) জানান, নারী দিবস কি আমি জানি না। আর নারী দিবস পালন করলেও আমার কোন লাভ নেই। আমি জানি কাজ করলে পেটে ভাত আর কাজ না করলে থাকতে হবে উপবাস। আমার সংসারে অভাব অনটনের কারণে একটু সচ্ছতা ও সুখের জন্য আমি প্রত্যেক দিন চাতালে কাজ করছি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাহফুজা খাতুন বলেন, এলাকায় নারী শ্রমিকরা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেন। নারীরা বাহিরে কাজ করে সংসারেও কাজ করেন। সরকার নারী নির্যাতন বন্ধসহ গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন ও উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন। নারীরা যেভাবে পুরুষদের সঙ্গে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছে, সেই ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেও অর্ধেক মজুরি পান নারীরা। তাই নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সমান মজুরি নিশ্চিত করার প্রয়োজন।
কালাই উপজেলার নির্বাহী অফিসার জান্নাত আরা তিথি বলেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হলেও এখনো আমরা নারী-পুরুষের সমতার জায়গাতে যেতে পারিনি। দেখা গেছে পরিবারে নারী সদস্য চেয়ে পুরুষ সদস্যকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমাদের প্রয়োজন নিজ নিজ পরিবার থেকে নারীদের সচেতন হওয়া উচিত।
তৌহিদুল ইসলাম তালুকদার লায়নর/স্টাফ-রিপোর্টার
কোন মন্তব্য নেই